স্বদেশ ডেস্ক:
রাজধানীর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা মো. আনিস রহমান। প্রতিমাসে বেতনের ৩০ হাজার টাকা থেকে বিদ্যুৎ বিলসহ বাড়ি ভাড়া দিতে হয় সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। অফিস যাতায়াতের জন্য তুলে রাখতে হয় ৪ হাজার টাকা। রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের খরচটাও বেড়ে এবার আড়াই হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। ইন্টারনেট বিল ৫০০ টাকা। এর সঙ্গে বাজার খরচসহ সংসারের পেছনে বেতনে পুরো টাকাটাই ব্যয় হয়ে যায় আনিসের। এর বাইরে পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে ঋণ করা ছাড়া উপায় থাকে না তার। প্রতিমাসে ঘাটতির হিসাব কিছুতেই যেন মিলাতে পারেন না আনিস। আয় বুঝে ব্যয় করেও প্রতিমাসে তার ঋণের বোঝা কেবল বাড়ছেই।
আনিস বলেন, ‘করোনা মহামারীর পর থেকে বাজার, যাতায়াত, চিকিৎসাসহ একে একে সব কিছুর খরচ বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ গ্যাস সিলিন্ডারের দামটাও বেড়েছে। কাজের বুয়া, ডিশের লাইনসহ অনেক খরচ বাদ দিয়েছি। তার পরও খরচ মিলাতে প্রতিমাসে ঋণ করতে হচ্ছে। এভাবে চললে ঢাকা ছাড়তে হবে।’ করোনা পরিস্থিতিতে বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি হারিয়ে বিপাকে রয়েছেন মো. হাসনাইন আহমেদ উজ্জ্বল। ফার্মগেট তেজতুরী বাজার এলাকার একটি মেসে থেকে চাকরি খুঁজছেন তিনি। এরই মধ্যে মেসের সিট ভাড়া ও খাওয়া খরচ বেড়ে যাওয়ায় টিকে থাকার যুদ্ধে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে এ তরুণকে। উজ্জ্বল বলেন, ‘এমনিতেই বেকার, তার ওপর সিট ভাড়া ৪০০ টাকা বেড়েছে। দুই বেলার খাবার বাবদ মাসে খরচ ৫০০ টাকা বেড়ে আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। সকালে হোটেলে নাস্তা করতে হয়। সেখানেও ১০ টাকার ভাজি ১৫ টাকা হয়েছে, ৫ টাকার পরোটা ৬ টাকা হয়েছে। সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, ঋণ বাড়ছে। খরচ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই শহরে কোনোভাবে টেনেটুনে টিকে থাকাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে।’
চাকরিজীবী আনিস কিংবা বেকার তরুণ উজ্জ্বল- নিত্যদিনের খরচের দৌড়ে এখন সবাই দিশেহারা। বাজার থেকে শুরু করে বাড়িভাড়া, যাতায়াত, চিকিৎসা, খাদ্যসামগ্রী, প্রযুক্তি পণ্য- সব কিছুর দাম বেড়েছে। একে একে ব্যয়ের হিসাবের অঙ্ক বড় হলেও মানুষের আয় বাড়েনি। বিশেষ করে স্থির আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না। উল্টো করোনাকালে অনেকের তা কমেছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় সঞ্চয় ভেঙে চলেছেন অনেকে। দ্বিতীয় ধাক্কায় ঋণের বোঝা বেড়েছে। এখন জীবনযাত্রায় ব্যয়ের চাপে রয়েছে মধ্যবিত্তরা। দিশেহারা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছে দরিদ্র মানুষেরা। তিন বেলার আহার জোগাতেই নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে তাদের।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, করোনাকালে যারা বেকার হয়েছেন তাদের অনেকে এখনো কর্মে ফিরতে পারেননি। ফিরলেও আগের অবস্থানে নেই। রেমিট্যান্স প্রবাহও কমছে। এমন অবস্থায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় স্থির আয় মানুষ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কর্মসংস্থানে যারা রয়েছেন, তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
তিনি আরও বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে, আমাদের উৎপাদন ও আমদানি সরবরাহকে ভারসাম্য করে পণ্যের মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখতে না পারলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় অসমভাবে বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবনমান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘করোনার প্রভাবে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের আয়-রোজগার ব্যাপকভাবে কমেছে। অপরদিকে বিগত তিন বছরের মধ্যে ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় সর্বাধিক বেড়েছে। এ বছর আরও বেড়েছে। এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যেভাবে সব ধরনের খরচ বাড়ছে এতে মুদ্রাস্ফীতির আশু লক্ষণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এখনই যদি এর লাগাম টানা না যায় তা হলে দেশের অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা, তা হুমকির মুখে পড়বে।’
ক্যাবের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০১৯ সালে যা ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ ও ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ ও ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ ছিল। ২০২০ সালে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের গড় বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সময়ে ওয়াসার পানি প্রতি হাজার লিটারে দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আবাসিকে বিদ্যুতের গড়মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এ ছাড়া বাজারে নিত্যপণ্যের দামও ব্যাপক হারে বেড়েছে বলে জানায় সংগঠনটি।
বাজারদরের সম্প্রতি চিত্রও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। চাল, তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, মুরগি, ডিমসহ অত্যাবশকীয় সব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও স্বস্তির খবর দিতে পারছে না সরকার। উল্টো সয়াবিন তেল ও চিনির দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ টাকা ছুঁই ছুঁই। পেঁয়াজ আমদানিতে পাঁচ শতাংশ শুল্ক ছাড় দিয়েছে সরকার। বাজারে এখনো বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা কেজি। আটার দামও দুই কেজির প্যাকেটে পাঁচ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়। মসুর ডালের (দানাভেদে) কেজি এখন ৯০ থেকে ১৩০ টাকা। গুঁড়াদুধের দামও কেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়েছে।
গরিবের প্রোটিনের প্রধান উৎস ব্রয়লার মুরগির দামেও এখন আগুন। বাজারে বেশিরভাগ সবজির দাম ৫০ টাকার ওপরে। ডিম খেয়ে দিন কাটানোর দিনও শেষ। এক ডজন (১২ পিস) ডিম কিনতে গুনতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হালনাগাদ তথ্যও বলছে, এক বছরের ব্যবধানে চাল, আটা, ময়দা, তেল, ডাল, রসুন, হলুদ, আদা, গুঁড়াদুধ, চিনি, লবণ, মুরগি, কাগজ, রডসহ বিভিন্ন মসলার দাম অনেক বেড়েছে।
এরই মধ্যে বেসরকারি বিপণন কোম্পানিগুলোর আবেদনে দেশের বাজারে সিলিন্ডারে বিক্রি হওয়া তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতিকেজিতে ২২ শতাংশ দাম বাড়ার পর ১২ কেজি ওজনের এক একটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম পড়ছে ১২৫৯ টাকা (মূসকসহ), যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১০৩৩ টাকা। নিত্যপণ্য ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁ ও বেকারি পণ্যের দামও বাড়ছে। মেস ও হোস্টেলের ভাড়া ও খাবারের খরচও বেড়েছে। কোথাও কোথাও টং দোকানে এক কাপ চায়ের দামও এখন এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। কলার দাম আগে থেকেই বাড়তি। নতুন করে বেড়েছে রুটি-বিস্কুটের দামও।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনশাস কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, গ্যাসের সংকট নেই। তা হলে কেন গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। এতে মারাত্মক দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। গ্যাসে সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও দাম সহনীয় পর্যায়ে আনা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলে সবার আগে বিপদে পড়েন সীমিত ও স্থির আয়ের মানুষেরা। অপরদিকে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। এতে নিম্ন ও নিম্নবিত্তদের ওপর চাপ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকতে হবে। এর জন্য উৎপাদন, আমদানি, মজুদ ও সরবরাহের প্রকৃত তথ্য থাকতে হবে সরকারের কাছে। পাশাপাশি দরিদ্র ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তথ্য থাকতে হবে। আমাদের তথ্য-উপাত্ততেই গলদ রয়েছে। এখানটা ঠিক করতে হবে আগে। তার পর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছে। আগের মাস জুলাইয়ে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আগস্ট মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। আগের মাস জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সরকারি হিসাবের মূল্যস্ফীতিতে জীবনযাত্রার সব খরচ ঠিকঠাক ধরা পড়ে না উল্লেখ করে সিপিডি বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ধরনের পণ্যসহ আমাদের অনেক খরচ রয়েছে, যা যোগ হলে মূল্যস্ফীতির চিত্রটা ভিন্ন হতো। আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি। কিন্তু বর্তমানে মানুষের খাদ্যবহির্ভূত খরচও কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে মানুষের আয় ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে সঙ্গতি বজায় রাখাটা জরুরি। কারণ মানুষের আয় বেশি থাকলে মূল্যস্ফীতির চাপ এক রকম, আয় কম থাকলে চাপ আরেক রকম হবে। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষের আয় কমেছে, তাই চাপটা বেশি অনুভূত হচ্ছে।’
বর্তমানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে করোনা সনদ প্রয়োজন হওয়ায় খরচ বেড়েছে মানুষের। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে। অন্যদিকে যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রিকশা ভাড়া গড়ে অন্তত দশ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। কোনো কোনো রুটে বাস ভাড়া পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সরকারের নির্দেশনা ছাড়াই জনপ্রতি ভাড়া পাঁচ টাকা বাড়ানোয় লাব্বাইক বাসের হেলপারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন মাতুয়াইলের বাসিন্দা মো. আবু বকর। তিনি বলেন, ‘মাতুয়াইল মেডিক্যাল থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছে জনপ্রতি ৩০ টাকা করে। অথচ গত মাসেও ২৫ টাকা ছিল।’ বাসের ড্রাইভার জানান, কোম্পানি থেকে নির্দেশ থাকায় ভাড়া বাড়িয়েছেন তারা।